Magic Lanthon

               

রায়হানুল রানা

প্রকাশিত ১৭ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘এয়ারটেল প্রেজেন্টস্’

বন্ধুত্ব ডিজলভ্ হলো সওদাগরিতে

রায়হানুল রানা


টেলিভিশন আজকের সময়ের অন্যতম শক্তিশালী গণমাধ্যম। আর হবেই না বা কেনো, যখন কোনো ঘটনাকে খুবই অল্প সময়ের তৎপরতায় টিভি পর্দায় হাজির করা যাচ্ছে, তখন তো এই মাধ্যমের শক্তি মেনে নিতেই হয়। তাই আমরা না চাইলেও টেলিভিশন ঢুকে পড়ছে আমাদের মনের গভীরে। এ নিয়ে গার্বনার ও তার সহকর্মীরা যেমনটি বলেছেন, টেলিভিশন জাতির শক্তিমান গল্পকথকএটি অধিকাংশ মানুষের কাছে অধিকাংশ সময়ে অধিকাংশ গল্প করে। এখন আর ভূখণ্ড দখল করে উপনিবেশ স্থাপনের দরকার হয় না। বাস্তব পৃথিবীকে প্রতিচ্ছবি করার বদলে টেলিভিশন নির্মাণ করছে সমাজ ও মানুষের নয়া আদল, নয়া মূর্তি ও প্রতিমূর্তি। তুলে ধরছে নতুন এক পৃথিবীর ছবি, যা আপাত চেনা মনে হলেও আসলে চেনা নয়। এ পৃথিবী ক্ষণে ক্ষণে তার অবয়ব পাল্টায়, আলো-আঁধারির খেলায় চোখ ও মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর চিনতে গেলেই মস্ত ধাঁধা লাগে।

আর টেলিভিশন নামের এই দৃশ্যমাধ্যমে সর্বাধিক উপস্থিতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির। কারণ বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রধান অনুঘটক এই শ্রেণি। সবক্ষেত্রে তাদের পদচারণার ফলে তারা নিজেরা যেমন অনেক কিছু দ্বারা প্রভাবিত, ঠিক তেমনি তাদের দ্বারাও অনেকে প্রভাবিত। আর এই দুই ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে দৃশ্য-গণমাধ্যম। ফরাসি মার্কসবাদী নৃ-বিজ্ঞানী লুই আলথুসার রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্ব গঠন ও রক্ষায় দুই ধরনের হাতিয়ার বা যন্ত্রের কথা বলেছিলেন। প্রথমটি নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র, অন্যটি মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র। দ্বিতীয়টির মধ্যে রয়েছে জাতীয়তাবাদী প্রচার-প্রচারণা ও গণমাধ্যম। আর এই গণমাধ্যম একদিকে যেমন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মতাদর্শের বাহক, অন্যদিকে অর্থনৈতিক নীতির সাংস্কৃতিক প্রকাশও ঘটায়। যার সঙ্গে মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, সাম্রাজ্যবাদ বহুমাত্রিক সম্পর্কে আবদ্ধ।

আমাদের দেশের চলতি দৃশ্যমাধ্যমগুলোর মধ্যে টেলিভিশন সবচেয়ে বড়ো দৃক নেটওয়ার্ক। কাজেই এর একটি বাণিজ্যিক দিকও আছে। ফলে পণ্য বিপণন ও বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে ভোক্তা চাহিদা বাড়ানোর সঙ্গে এটি যেমন সম্পৃক্ত, ঠিক তেমনি শিল্প-সংস্কৃতির পণ্যায়ন প্রক্রিয়ারও সবচেয়ে বড়ো ক্ষেত্র। আজকের আলোচনা সেই শক্তিশালী দৃকমাধ্যম টেলিভিশনের অন্যতম উৎপাদ টিভি-নাটক কাম টেলিছবি ও তার বিরতিতে আসা বিজ্ঞাপন নিয়ে।

 

টেলিভিশন, টিভি-নাটক, টেলিফিল্ম ও আমাদের দর্শক

আমাদের দেশে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সব শ্রেণির মানুষের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম ছিলো চলচ্চিত্র। সবেধন নীলমণি একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে সঙ্গী করে তখন আমাদের কাটতো দিন-রাত। বিনা পয়সায় বিনোদন বলতে সপ্তাহে ওই একটি নাটক, একটি ধারাবাহিক আর মাসে বড়োজোর একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হতো টেলিভিশনে। তাই দর্শক বাড়তি বিনোদনের জন্য মাঝেমাঝেই প্রেক্ষাগৃহে যেতো বই মানে চলচ্চিত্র দেখতে। সময়ের পরিবর্তনে দেশে অনেকগুলো টিভি চ্যানেল হলো; পরিকল্পিত বলি আর অপরিকল্পিত বলি কিংবা অবহেলা বলিআমাদের চলচ্চিত্র তার জায়গা হারাতে থাকলো। ফলে একপর্যায়ে কেবল টেলিভিশন হয়ে উঠলো বৃহৎ মানুষের একমাত্র বিনোদন মাধ্যম।

এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কিন্তু এমনটা ঘটেনি। টিভি ইন্ডাস্ট্রি আর চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি সেখানে একে অন্যের হাত ধরাধরি করে চলছে। যাক সেসব কথা। চলচ্চিত্রের যখন এই অবস্থা তখন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সবার কাছে জাদুর বাক্স হয়ে এলো টেলিভিশন। আর বিপুল সংখ্যক এই দর্শকের চাহিদা পূরণে দিন-রাত কাজ করতে থাকলো এই ইন্ডাস্ট্রি। আর সেই সুযোগে নির্মাণ হতে থাকলো মানহীন-মানসম্মত সব টিভি-নাটক, টেলিফিল্ম।

বর্তমান সময়ে যে টিভি-নাটক আমরা দেখি বাংলাদেশে এর জন্ম মূলত মঞ্চনাটক থেকে। আর বাংলাদেশ টেলিভিশনে যার হাত ধরে এই নাটকের যাত্রা তিনি হলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। অন্যদিকে যাকে টেলিফিল্ম বলছি তা টেলিভিশনের দর্শকদের জন্য নির্মিত একধরনের চলচ্চিত্র; যেখানে ব্যাপ্তির চেয়ে মাথায় রাখা হতো দর্শক ও ফরম্যাট (যদিও আজ আর ফরম্যাটের এই তত্ত্ব খাটে না, কারণ এখন চলচ্চিত্র-নাটক-বিজ্ঞাপন সবকিছুই ডিজিটাল ফরম্যাটেই নির্মাণ হচ্ছে)। মূলত বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন একুশের হাত ধরেই টেলিফিল্মের যাত্রা শুরু হয়। ধীরে ধীরে প্রযুক্তির বিকাশে তা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে যা হলো টিভি-নাটক উৎপত্তিতে যে কাঠামো ছিলো, তা আর সে জায়গায় থাকলো না।

একদিকে প্রযুক্তির বিকাশ অন্যদিকে কিছু উদ্যমী নির্মাতার আগমন এই শিল্পের ধরন পাল্টে দিলো। ফলে টিভি-নাটক আর টেলিফিল্মের মধ্যে পার্থক্য বলে কিছু থাকলো না। আর একটি বিষয়, যে উদ্যমী নির্মাতারা এই শিল্পে আসতে লাগলো তাদের টার্গেট কিন্তু নাটক বা টেলিফিল্ম নির্মাণ ছিলো না, ছিলো চলচ্চিত্র। ফলে তাদের নির্মিত নাটক-টেলিফিল্মে নানাধরনের চলচ্চিত্রিক ভাষা ঢুকে গেলো।

টিভি-নাটক, টেলিফিল্ম নিয়ে আমার যে পর্যবেক্ষণ তা শুনে মনে হতে পারে অবস্থা তো তাহলে ভালো। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি মোটেও এ ধরনের নয়। এটা সামান্য অংশের চিত্র মাত্র। তবে কিছু ভালো নাটক যে হচ্ছে না, এমন নয়। তবে বেশিরভাগের অবস্থাই যাচ্ছে তাই। তার ওপর টেলিভিশনের একমাত্র আয়ের উৎস বিজ্ঞাপনের চাপ তো আছেই। ৪০ মিনিটের নাটকে বিজ্ঞাপনই চলে হয়তো ২০ মিনিট। আর এক ঘণ্টার টেলিফিল্ম যে কখন শেষ হবে তা বলা মুশকিল। বিজ্ঞাপনের এই দাপট এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে, কোনো কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের উদ্দেশ্য জানান দিতে সরাসরি নাটক-টেলিফিল্ম প্রযোজনায় নেমে গেলো। এর আগে নাটক-টেলিফিল্ম এমনকি চলচ্চিত্রে বিজ্ঞাপিত পণ্যের দু-একবার উপস্থিতি চোখে পড়লেও, এবার এলো একেবারে অন্যভাবে। ফলে যা হলো উপরে থাকলো নাটকের ধোঁয়া আর নিচে পুরো নাটকই হয়ে উঠলো পুরোদস্তুর পণ্যের বিজ্ঞাপন। আর পুঁজির ইঁদুর-দৌড়ে যা হয়, সবাই ঘিরে ধরলো তাদের, বাহ্ বাহ্ বললো, আলোচনা হলো, মোটা দাগে হলো স্বার্থগত সঞ্চালন মানে ম্যানিপুলেশন।    

 

টিভি-নাটক, টেলিফিল্ম ও এয়ারটেল

টিভি-নাটক, টেলিফিল্মের যখন এই অবস্থা তখন বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর এয়ারটেল নিজেদের প্রযোজনায়, নিজেদের মতো করে কয়েকটি টেলিফিল্ম নির্মাণে এগিয়ে এলো। তার আগে অবশ্য বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল আর বন্ধুদের কানেক্টেড রাখে এয়ারটেলবন্ধুত্ব কেন্দ্রিক এ ধরনের নানা স্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছিলো এয়ারটেল।

বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলে বলতে থাকলো, একা একা নিজের মনে/ একা বসে ভাবা/ একা কিছু করা বা না করা/ সব একা একা/ সব বসে কেনো একা একা/ একা আবার লাইফ হয় না কি/ ফ্রেন্ড ছাড়া লাইফ চলে কি বল্/ নেট ছাড়া ফ্রেন্ডস্ ইম্পসিবল। স্লোগান, জিঙ্গেল, বিলবোর্ড আর কলরেটের বিশেষ ছাড়ে বন্ধু নিয়ে আমরা যখন মাতোয়ারা, তখন এয়ারটেল নিয়ে আসলো বন্ধুত্বের আরো মাতোয়ারা গল্পের টেলিফিল্ম। দৃকমাধ্যমে একধরনের বাস্তবতা নির্মাণ করলো এয়ারটেল। সেই বাস্তবতার অবস্থান অবশ্যই টার্গেট অডিয়েন্সের বাস্তবতা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ফলে প্রকৃত বাস্তবতা আর প্রত্যাশিত বাস্তবতা এক হতে থাকলো। আর তাতে জয়ী হতে থাকলো এয়ারটেল। আবার সেই বাহবা।

 

‘এয়ারটেল’ বন্ধুত্ব

সেই বাহ্বা পাওয়া টেলিফিল্মের একটি ইফতেখার আহমেদ ফাহমিআমাদের গল্প। আসিফ, ইমরান, রাসেল, নিভৃত ও ফাইয়াজ নামে পাঁচ বন্ধুর গল্প এটি। সাত বছর বিদেশে থেকে স্কুলের ৫০ বছরপূর্তিতে যোগ দিতে ছেলে ও স্ত্রীকে রেখে দেশে আসে আসিফ, ওঠে বন্ধু ফাইয়াজের বাংলোয়। এরপর নিভৃত ছাড়া অন্যদের সঙ্গে দেখা হয় আসিফের। এদিকে বড়োলোক বাবার একমাত্র ছেলে ফাইয়াজের স্ত্রী অসুস্থ। স্ত্রীর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা; তার দুশ্চিন্তা কমাতে নানা মজা করে তাকে ব্যস্ত রাখে ফাইয়াজ। উঠতি নির্মাতা ইমরান টিভি-নাটক, সিরিয়াল, মডেল নিয়ে ব্যস্ত। তবে বন্ধুত্বেও তার ঝোঁক প্রায় সমান। আর বোহেমিয়ান রাসেলের সঙ্গী গল্প, কবিতা; সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলতি অস্থির সমাজকে ঘিরে।

অন্যদিকে রহস্যময় নিভৃতের খোঁজে যখন সবাই অস্থির, তখন রাসেল জানায় তিন বছর আগে নিভৃতের জীবনের চরম পরিণতির কথা। শোকে পাথর নিভৃতের মায়ের অদ্ভুত-নির্মম আচরণ বন্ধুদের মধ্যে শোকের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। আর পুরনো প্রেমিকা ফারিয়ার সঙ্গে ঘটনা চক্রে আসিফের দেখা হওয়ার পর বেরিয়ে আসে নতুন আরেক গল্প। যে গল্প ফারিয়াকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে; বাকি জীবনের জন্য তাকে পরিয়েছে শ্বেত-শুভ্র পোশাক। এ রকম কয়েকটি গল্প নিয়েই আমাদের গল্প। সাদা চোখে এয়ারটেল টেলিফিল্ম-এর এই কাহিনী শিহরণ জাগায়, আবেগী করে, বন্ধুপ্রেমী তরুণদের মুখে প্রশংসার ফুলঝুরি ঝরে; মনে হয় বন্ধুত্বের অসাধারণ উপস্থাপন। অবশ্য এয়ারটেল-বন্ধুত্ব তার উদ্দেশ্য সাধনে শতভাগ সফল। কিন্তু প্রশ্ন, কোন্ বন্ধুত্বের কথা বলছে আমাদের বন্ধুপ্রেমী এয়ারটেল?

 

বন্ধু মার্কস-এঙ্গেলস : মোরা কান পেতে রই

পৃথিবীর বিখ্যাত সব বন্ধুত্ব কাহিনীর অন্যতম কার্ল মার্কস আর ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। মার্কস-এঙ্গেলস দুই বন্ধু মিলে সারাপৃথিবীর মানুষের জ্ঞানকাণ্ডে আঘাত করেছিলেন। পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন সারাপৃথিবীর মেহনতি মানুষের মুখ। আর আজকের বন্ধুত্ব কবর খুঁড়ে বন্ধুকে এনে হত্যার চেষ্টা করে, কিংবা বন্ধুর লাশ পুঁতে কচুগাছ লাগায় দুই বন্ধু। এয়ারটেল তাহলে কোন্ বন্ধুত্বের কথা বলছে!

প্রত্যেকের জীবনেই সঙ্কট আছে; কারো খেতে না পাওয়ার, কারো খাওয়ার মান-পরিমাণ-উপাদান না বাড়ার। মধ্যবিত্তের এয়ারকন্ডিশন নাই, সেটা যেমন সঙ্কট; আবার গরিবের রোদ-বৃষ্টি থামাবার চালা নাই, সেটাও তেমনি সঙ্কট। আবার কেউ একটা টয়োটা করোলা গাড়ি ছেড়ে মার্সিডিজ বেঞ্জ কিনতে চায়, সেটাও কারো কারো সঙ্কট।

সঙ্কটটাই আসলে একটা সঙ্কটসেরকমই একটা পরিস্থিতি নির্মাণ করা হয় বা হয়েছে। আসিফের (তাহসান) কথাই ধরুন, সে বন্ধুদের খুঁজে বেড়াচ্ছে আজ সাত বছর পরে এসে। সে কী আবেগ! আবেগ আছে, আবেগ থাকা ভালো, কিন্তু ধনবান আসিফ কী করেছে ওই বন্ধুদের জন্য এই সাত বছরে। কিছুই না!

অন্যদিকে রাসেল (রওনক হাসান) জানে নিভৃত মারা গেছে, কিন্তু কথাটা কাউকে বলে না। কারণ সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নিভৃতের মায়ের কান্নার আবেদন। সে নিভৃতের বাসায় মাঝে মাঝে মানি-অর্ডার পাঠায়, কেননা সে তো জানে, ওই পরিবারে উপার্জন করার মতো আর কেউ নেই।

আর ফাইয়াজ (ইরেশ যাকের) একেবারে বুর্জোয়া পরিবারের সন্তান। বন্ধুদের সঙ্গে তার এতো ভালো সম্পর্ক অথচ তিন বছর আগে নিভৃত মারা গেছে সে একবারও বুঝতে পারলো না। আর বুঝবেই বা কীভাবে, তারতো সবকিছু স্ত্রীকে ঘিরেই, কারণ তার স্ত্রী অসুস্থ।

অথচ নিভৃতরা কেনো নষ্ট হয়, কেনো মাদকাসক্ত হয়ে আত্মহত্যা করে? তার উত্তর কেউ দেয় না। নাকি দিলে আঁতে ঘা লাগে। কারণ বড়োলোক বন্ধুরা যখন অনেক কিছু করতো, অনেক জামা-কাপড় কিনতো, তখন নিভৃতের বেলায় ঘটতো উল্টোটা। সাধ থাকলেও পূরণের সাধ্য ছিলো না। এই ইচ্ছা আর ইচ্ছাপূরণের ফারাকেই হয়তো তার মাদকাসক্ত হওয়া, একপর্যায়ে হয়তো বেছে নেওয়া আত্মহননের পথ।

নিভৃত মারা যাওয়ার পর তার মা রাসেলকে বলেছিলো, প্রতি ঈদে তোমরা কাপড় কিনতা, হেও কাপড় কিনতো। পরপর সাতটা ঈদ গেলো কোনো কাপড়-চোপড় দিতে পারি নাই। তোমরা নতুন কাপড় পিনদা ঘুরতা আর তোমাগো বন্ধু নতুন কাপড় পাইতো না, তার কেমন লাগবো কও! এই যে নেশা-ভাঙ শুরু করলো। অভাবী সংসারে উপার্জন করার মতো তো কেউ ছিলো না নিভৃতের; বাবা, বড়ো ভাইও মারা গিয়েছিলো। আয় বলতে কেবল মায়ের সেলাইয়ের কাজ।

কিন্তু দেখেন, নিভৃতের অভাবী মায়ের চিন্তা কিন্তু অনেক পরিষ্কার। তিনি কাউকে বলেননি, তার ছেলে মারা গেছেন। তার ভাষায়, সবাই জানবো নিভৃত আছে। আমি চাই আমার ছেলে বাঁইচা থাকুক। আসবো সবাই, খুঁজবো প্রত্যেকদিন। আমি কবো, হ বাইরে আছে, কোনোখানে আছে। থাকুক না আমার ছেলে ওই রকমভাবে, বাঁইচা থাকুক। পুরো নাটক জুড়ে তিনিই একমাত্র ভরসা যিনি স্বপ্নটাকে জিইয়ে রেখেছেন; এতো কষ্টের মধ্যেও বলেছেন স্বপ্নের কথা, হোক না সে স্বপ্ন জাগতিক মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা যারা দিন দিন চাহিদার গ্যাঁড়াকলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছি, তারা তো ছুঁতে পারা স্বপ্ন দেখতেও ভুলে গেছি।

আবার ফারিয়া (জয়া আহসান), আসিফের সঙ্গে তার একসময় প্রণয় ছিলো। একপর্যায়ে ফারিয়া আসিফকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে, কেননা সে অন্তঃসত্ত্বা ছিলো; কিন্তু কথাটা সে আসিফকে বলতে পারেনি, আর আসিফ তখন নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত; সে বিয়ে করতে চায় না বরং ফারিয়াকে অপেক্ষা করতে বলে। ফলে প্রেমটা ভেঙে যায়। এদিকে ফারিয়া প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেবল সমাজের ভয়ে গর্ভপাত করান। কিন্তু এই হত্যা সে মেনে নিতে পারে না। আর এ কারণেই অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ের এতো দিন পরেও ফারিয়া ওই হত্যার অপরাধবোধ-এ সাদা পোশাক ছাড়া অন্য কোনো রঙ পরে না। হয়তো অন্য সব রঙ ওই হত্যার মধ্য দিয়েই তার জীবনে ম্রিয় হয়ে গিয়েছিলো। কী চমৎকার একটা চরিত্র দিয়ে মানুষের আবেগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা! পরিচালক বাহ্বা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন অবশ্যই!

প্রশ্ন হলো, ফারিয়া আর আসিফের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা তাহলে কতোটুকু? যে কারণে ফারিয়া অন্তঃসত্ত্বা  হওয়া সত্ত্বেও একবারও আসিফকে বলতে পারলো না সে কথা! আসিফকে বললে হয়তো পরিস্থিতি এমন নাও হতে পারতো। মোটেও বলছি না, সব ঠিক হয়ে যেতো; তবে তাকে অবশ্যই সবকিছু খুলে বলা যেতো। কেননা ভালোবাসা তাই, যেখানে একজন আরেকজনের কাছে সবকিছু খুলে বলতে পারে, ভাগাভাগি করতে পারে সুখ-দুঃখ। অথচ ফারিয়া তা করলো না। অন্য বন্ধুরাইবা এই সঙ্কটে কী করলো!

আসিফ আর ফারিয়ার সঙ্কটে কোনো বন্ধু তো তাদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসলো না। ফারিয়া তার সঙ্কট আসিফকে না বলে রাসেলকে বললো। আচ্ছা ঠিক আছে, রাসেল তো একবারও আসিফকে বলতে পারতো বিষয়টা; কিন্তু রাসেল তা না করে ফারিয়াকে গর্ভপাতের পরামর্শ দিলো। এখানেও প্রশ্ন, রাসেল, ফারিয়া, আসিফ মিলে তাহলে এ কোন্ বন্ধুত্ব? এখানে যে বন্ধুত্বটার কথা বলা হচ্ছে, সেটা তাহলে কী? তা কেমন? বন্ধুদের সঙ্কটে তো কোনো বন্ধুকে দেখা গেলো না।

আসিফ-ফারিয়ার সঙ্কটে যেমন কেউ এগিয়ে আসেনি, ঠিক তেমনি নিভৃতের সঙ্কটেও কেউ এগিয়ে আসেনি। বিপরীতে ফাইয়াজ তার স্ত্রীর সমস্যার কথা সবার সঙ্গে শেয়ার করে, এতে বন্ধুরা সেটা বুঝতে পারে এবং তার পাশেও থাকে। আসলে এটা কি বন্ধুত্বের জন্য নাকি ফাইয়াজের শ্রেণিচরিত্রের জন্য? কেননা ফাইয়াজ অনেক ক্ষমতাবান, সে অনেক টাকাওয়ালা, তার বাসায় থাকা যায়, আড্ডা মারা যায়। বন্ধুদের কাছে ফাইয়াজের সমস্যাটা বলা গেলো কিন্তু আসিফ-ফারিয়া বা নিভৃতের সমস্যার কথা বললো না কেউ!

মানুষ আল্টিমেটলি একেবারে একা থাকতে পারে না। তার কোনো না কোনো ধরনের বন্ধু দরকার পড়ে। সেই বন্ধু যেমন মার্কসের জন্য এঙ্গেলস হয়, আবার একটা ল্যাপটপের জন্য গলা কেটে ফেলেও বন্ধু হয়। একটু ভাবুন তো এয়ারটেলের বন্ধুরা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ কোনো অপ্রয়োজনীয় চাহিদা তৈরি করছে নাতো? যেমন : তুই এটা করছিস, আমি এটা করতে পারছি না। আমি এটা করছি, তুই এটা করতে পারছিস না; একটা প্রতিযোগিতা, সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতাটা কেমন জানি ইতিবাচক না। কিংবা যা নিয়ে এই প্রতিযোগিতা, তার আদৌ দরকার আছে কি নাসেই প্রশ্ন তোলাও জরুরি। হ্যাঁ এটা ঠিক, আজকের দিনে মুঠোফোন, ইন্টারনেট ছাড়া হয়তো জীবন অনেকখানি অচল। প্রশ্ন, কেমন ধরনের অচল?

 

মাউসের ক্লিকে বন্ধু হয় সকলে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব ছিলো দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের। তাদের বন্ধুত্বটা এমন ছিলো যে একজনকে ডাকা হতো রবীবাবু আরেকজনকে দ্বিজবাবু। দুজনেই গান সৃষ্টি করতেন, নাটক লিখতেন আবার একে অপরের সমালোচনাও করতেন। রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন দ্বিজবাবুর লেখার সমালোচনা করেছেন, আবার কোনোটার আকাশছোঁয়া প্রশংসাও করেছেন; তার কবিতার ইংরেজি অনুবাদও করে দিয়েছেন। আর তার বন্ধু দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যিনি একসময় রবীন্দ্রনাথকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি বলে মেনে নিয়েছিলেন, তিনিই আবার রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ বলে বারবার আঘাত করেছেন। কিন্তু তাদের বন্ধুত্বের মাত্রায় চির ধরেনি একটুও।

আবার দেখুন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কোনো এক কারণে রবীন্দ্র বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন; কিন্তু বন্ধু রবীন্দ্রনাথ তাদের বন্ধুত্বে একটুও অসম্মান হতে দেননি। তিনি ধৈর্য ধরে বন্ধুকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, খোঁজার চেষ্টা করেছেন তার  বিদ্বেষের কারণ। কোনো প্রতিবাদ তো করেননিই বরং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখার প্রশংসা করেছেন। কী বন্ধুত্ব, একজন কঠোর সমালোচনা করছেন আর একজন করছেন প্রশংসা!

আবার ২০ শতকের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ফ্রান্সের আলবেয়ার কামু ও জঁ পল সার্ত্রে একে অন্যের ভালো বন্ধু ছিলেন। তারা একই সঙ্গে নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, দার্শনিক ও সম্পাদক ছিলেন। এবং দুজনেই কয়েক বছরের ব্যবধানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন সাহিত্যে। এটা ঠিক, সাহিত্য ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবন-যাপনে অনেক মিল থাকায় তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। তাদের বন্ধুত্বের বড়ো একটা উদাহরণ হচ্ছে, ১৯৪৫ সালে আমেরিকায় গিয়ে ফ্রান্সের নতুন সাহিত্য যুগের প্রতিনিধি হিসেবে সার্ত্রে বন্ধু আলবেয়ার কামুর নাম ঘোষণা করেন। তাদের মধ্যে যে শত্রুতা ছিলো না তা নয়, কিন্তু তারা সেটা স্বীকার করতেন না। তবে কামুর মৃত্যুর পর তাকে লেখা এক চিঠিতে সার্ত্রে লিখেছিলেন, প্রিয় কামু, আমাদের দুজনের মধ্যে যতটা বন্ধুত্ব ছিল, ততটাই ছিল শত্রুতা; কিন্তু তার পরও আমি আজ স্বীকার করছি যে আগামী দিনগুলোতে আপনার অনুপস্থিতি অনুভব করবো আমি। কারণ আপনিই ছিলেন প্যারিসের একমাত্র সাহিত্যিক, যিনি আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এমনকি মৃত্যুর আগে সার্ত্রে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সাহিত্যিকদের মধ্যে আলবেয়ার কামুই তার সবচেয়ে সেরা ও ভালো বন্ধু ছিলেন। ইতিহাস ঘাঁটলে এ রকম অনেক বন্ধুত্বের উদাহরণ পাওয়া যাবে।

মাউসের প্রতি ক্লিকে এখন আমাদের বন্ধু বাড়ছে, ফোনের প্রতি মিস্ডকল বাড়ছে বন্ধু। বন্ধুত্বের পাগল পারা উতাল হাওয়া বয় চারিদিকে, কিন্তু কোন্ দিকে যাচ্ছে সেই বন্ধুত্ব? রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল, মার্কস-এঙ্গেলস, আলবেয়ার কামু-জঁ পল সার্ত্রে নাকি ব্যবসায় প্রচ্ছন্ন কোনো নতুন জীবনের দিকে? বর্তমান সময় ও প্রযুক্তি আমাদেরকে যে বন্ধুত্বের দিকে টানছে সেখানে কি আদৌ বন্ধুত্ব বলে কিছু আছে?

বন্ধুত্ব বাড়ছে। ফোন, ফেইসবুক আমাদের বন্ধু বাড়াচ্ছে। আবার বন্ধু দিয়েও নতুন বন্ধু বাড়ছে। প্রযুক্তির এই মাধ্যমগুলোতে আমাদের পরিচিত বন্ধু যেমন আছে, তেমনি অপরিচিত বন্ধুও আছে। একটা মাত্র ক্লিকে আমরা আমাদের বন্ধু বাড়াচ্ছি। তাদের সঙ্গে কথা বলছি, ছবি শেয়ার করছি আরো কতো কী! তবে যে বন্ধুত্বের কথা তারা বলছে তার জন্য স্মার্টফোন কিনতে হয়, সঙ্গে থাকতে হয় ইন্টারনেটের হাজিরা। আর এই ফোন কিংবা ইন্টারনেটে হাজির থাকতে হলে ব্যালান্স লাগে, কিনতে হয় মেগাবাইট। আর তা যদি আপনি না পারেন, তাহলে আপনার এই বন্ধুত্ব টিকে থাকবে তো!

 

বন্ধু তোমার নতুন-নতুন সাথিকে চিনে নিও

আমাদের গল্প মোট এক ঘণ্টা ২৫ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডের গল্প; সময়টা তিনবারের বিজ্ঞাপন বিরতি সহযোগে। দুই মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে এয়ারটেল প্রেজেন্টস্ নিবেদিত দিয়ে আমাদের গল্প-এর শুরু। এরপর বিভিন্ন বিরতিতে দেখানো হয়, যেমন মুড তেমন স্ট্যাটাস সেট করো স্লোগানে এক জোড়া কপোত-কপোতির মোবাইলে ঝগড়া; ইন্সট্যান্ট ক্যাশব্যাক নিয়ে রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের কাছ থেকে ফাও খাওয়া; সঙ্ ক্যাচার নিয়ে কিপটে বন্ধুর ইনকামিং টোন চুরি করা আর সবশেষে ছিলো এয়ারটেল-এ কোন্ প্যাকেজে কতো অল্প টাকায় কথা বলা যায়, তার ফিরিস্তি।

একদিকে বন্ধু নিয়ে গল্প চলে, অন্যদিকে বন্ধু নিয়ে ব্যবসা। ব্যবসা আর বন্ধুত্ব একাকার হয়ে যায়, আর মার্কস-এঙ্গেলস, রবী-দ্বিজ, কামু-সার্ত্রে-রা ডুকরে কেঁদে মরে! হায় বন্ধুত্ব...

 

লেখক : রায়হানুল রানা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

rayhanulrana@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. আলোচনাটি সোনার দেশ, ২৮ জুন ২০১৩-তে মাহবুব অনিন্দ্যর লেখা টেলিভিশন, সিরিয়াল আর আমাদের সমাজ সংসার নামের প্রবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত করে নেওয়া।

২. বিস্তারিত জানতে পড়ুনকবর খুঁড়ে বন্ধুকে এনে হত্যার চেষ্টা শিরোনামের সংবাদটি; প্রথম আলো, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩।

৩. বিস্তারিত জানতে পড়ুনহায় রে বন্ধুত্ব! : লাশ পুঁতে কচুগাছ লাগাল দুই বন্ধু শিরোনামের সংবাদটি; প্রথম আলো, ২৩ এপ্রিল ২০১১।

৪. http://www.amarboi.com/2011/09/sunil-gangopadhaya-rabindranath-and.html

৫. বিপ্লব, শাহনেওয়াজ; বন্ধু ও শত্রু আলবেয়ার কামু ও জঁ পল সার্ত্রে; কালের কণ্ঠর শুক্রবারের বিশেষ ক্রোড়পত্র শিলালিপি, ১৫ নভেম্বর ২০১৩।

 

বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৪ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন